সুজন মন্ডল
শান্ত ও নীলা এক বছর হলো বিয়ে হয়েছে কোন সন্তানাদি এখনো হয়নি। খুব সুখেই কাটছিল তাদের প্রথম বিবাহবর্ষ। শান্ত ওর বাবার একমাত্র ছেলে, স্মার্ট ও সুশিক্ষিত বটে কিন্তু খারাপ গুন বদমেজাজি। শান্তর এই উগ্রতা ও বদমেজাজি স্বভাবের কারণে বহুবার ওর বাবা-মাকে নাকানিচুবানি খেতে হয়েছে কিন্তু স্বভাব না যায় মরিলে। আর নীলা মধ্যবিত্ত পরিবারের এক আদুরে কন্যা। স্বল্প বয়সে বিয়ে হবার কারণে শ্বশুরবাড়ির পরিস্থিতি মানিয়ে নিতে বেশ গলদঘর্ম অবস্থা।
স্বামীর রাগান্বিত ভাবমূর্তি ও শ্বশুরবাড়ির কূটচালের কবলে শ্বাস আসে যায় অবস্থা। শান্তর যে কোন কাজে নীলা আপ্রাণ নিবেদিত প্রাণ তবুও স্বামীর মন জয় করতে নীলা ব্যর্থ। প্রতিনিয়ত খুব ছোট ছোট ঘটনা কিংবা ভুলগুলো ওদের সংসারে রাম রাবনের যুদ্ধাংদেহী পরিস্থিতি বিরাজ করে । নীলার শরীরে নির্যাতনের ছোপ ছোপ রক্তের কালো দাগ, দৈনন্দিন কর্ম শেষে মাঝে মাঝে তিনবেলা খাবার খাওয়ার সময় জুটে না।
গভীর রাতে স্বামীর ঘরে ফেরা, সারাদিনের ক্লান্তি শেষে স্বামীর একটু আদর সোহাগের প্রত্যাশার বিপরীতে নির্যাতন ই যেন প্রাপ্য। তাই নীলা সিদ্ধান্ত নেয় এ ধরনীতে আমি থাকতে চাই না, আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েও বারবার ফিরে আসে “ধর্মীয় বানী ওর মাথায় আসে আত্মহত্যা মহাপাপ, আত্মহত্যা করলে নরকে যেতে হবে”। তাই নীলা সিদ্ধান্ত নেয়, স্বামীর নির্যাতন থেকে মুক্তি পেতে সংসার ত্যাগ করবে, স্বামীকে ডিভোর্স দিবে। একটু প্রশান্তির খোঁজে স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নেয়। কিন্তু আমাদের হিন্দু ধর্মে ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি মেয়ে ই যেন অপরাধী । মা, মাসী ও প্রতিবেশীদের পরামর্শ, শ্বশুরবাড়ি একটু মানিয়ে নিতে হয়, স্বামীরা এমন ই হয় কিংবা স্বামীর মুখে মুখে তর্ক করা জঘন্য অপরাধ। পুরুষ শাসিত এই সমাজে ডিভোর্স হলে সমস্ত দায় ভার ডিভোর্সি নারীর উপর বর্তায় আর পুরুষ যেন ধোয়া তুলসী পাতা। পুরুষ কখনোই ভেবে দেখে না যে, সে একটি পরিবারের রাজকন্যা কে বিবাহ করিয়াছে, তার সুখ দুঃখ বোঝার ও অনুভব করা একজন আদর্শ স্বামীর পূর্বশর্ত। সকল স্ত্রীরা লোভী নহে, তাদের একটু সুন্দর ব্যবহার দিয়েই মন জয় করা যায়।
নীলা বাবার বাড়ি তে একমাস অতিবাহিত হলো মাত্র ততদিনে শান্ত একাকিত্ব অনুভব করলো, কেউ আর খাবার তৈরি করে সামনে রাখে না, কিংবা মনখারাপের কারণ জানতে চায় না, স্নান শেষে কেউ আর ভিজে কাপড় রৌদে দেয় না। তাইতো নীলার অনুপস্থিতি শান্তকে অস্থির করে তুলল, পাড়ায় কানাঘুষা চলছে শান্তর বউ শান্তকে ছেড়ে চলে গেছে এতো খুব সন্মানহানিকর, যেভাবেই হোক নীলাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
নীলা নাছোড়বান্দা আমি ঐ নরকের সংসার করবো না, এ ঘটনা এ কান ও কান হতে হতে চেয়ারম্যান মেম্বার পর্যন্ত পৌঁছে যায়। সবাই নীলাকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়, নীলার একটাই প্রশ্ন মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া কি পাপ, মেয়েদের কি জীবন নেই, মেয়েদের শরীর কি রক্ত মাংসের নয়, তবে কেন একটা মেয়ে কে অবলা মনে করে এ সমাজ, কেন একটা মেয়েকে নির্যাতন করলে সমাজ প্রতিবাদ করে না। হিন্দু সমাজে বহু নারী হাজারো নির্যাতন সহ্য করে স্বামীর সংসার করছে যদি অন্য ধর্মের মতো ডিভোর্স সিস্টেম সহজ হতো তবে বহু সামাজিক লোকেরও সন্মান খসে পড়তো।
অতঃপর নানা জনের নানান পরামর্শের বদৌলতে একটি ভাঙন প্রায় সংসার পুনঃ জীবন পেল, ফিরে এলো নীলা তার আপন আলয়। একটু সুখ, একটু স্বপ্ন ও আগামী প্রজন্ম সৃষ্টি করার অভিপ্রায়। শান্ত ফিরে এলো সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে। হাসি আনন্দ আর খুনসুটিতে মেতে উঠেছে প্রতিটি প্রহর।