একাত্তরের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের এই উদ্দীপ্ত ঘোষণায় বাঙালি জাতি পেয়ে যায় স্বাধীনতার দিকনির্দেশনা। এই ঘোষণা বিদ্যুৎ গতিতে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
সেদিন লাখো মানুষের উপস্থিতিতে রেসকোর্স ময়দান ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। মুহুর্মুহু স্লোগান ছিল—‘তোমার আমার ঠিকানা/পদ্মা মেঘনা যমুনা’। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিল মাত্র ১৯ মিনিটের। এটুকু সময়ের ভাষণেই তিনি বাঙালির বঞ্চনার ইতিহাসের পুরো ক্যানভাস তুলে ধরেন। তারপর বলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তা–ই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’
বঙ্গবন্ধু ১ মার্চেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে বক্তব্য দেবেন। তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য সকাল থেকেই দেশের দূরদূরান্তের মানুষ দলে দলে পায়ে হেঁটে, বাসে-লঞ্চে-ট্রেনে চেপে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হতে থাকেন। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে নারী-পুরুষে সয়লাব হয়ে যায় বিশাল ময়দান।
বয়স, পেশা, সামাজিক মর্যাদা ভুলে গিয়ে সর্বস্তরের মানুষ হাতে বাঁশের লাঠি, কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি আর চোখে মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে এক ও অভিন্ন লক্ষ্যে নেতার নির্দেশ শোনার জন্য উপস্থিত হন। বেলা সোয়া তিনটায় বঙ্গবন্ধু সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন। সফেদ পায়জামা-পাঞ্জাবি আর কালো কোট পরে শেখ মুজিব মঞ্চে এসে দাঁড়ালে বীর জনতা করতালি ও ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে প্রাণপ্রিয় নেতাকে অভিনন্দন জানান।
বঙ্গবন্ধু তাঁর ১৯ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনের দুর্গম-দুস্তর পথের প্রান্তে বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্মৃতিফলক বসিয়ে দেন। সংগ্রামে উন্মুখ জাতির কাছে পৌঁছে দেন স্বাধীনতার মন্ত্রণা। লাখ লাখ মুক্তিসংগ্রামীর উদ্দেশে তিনি ঘোষণা করেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।…আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়,…আমি যদি হুকুম দিবার না–ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।…এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তা–ই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশা আল্লাহ।’