চাকরিপ্রত্যাশীদের মধ্যে বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে হুলুস্থুল শুরু হয়ে গেছে। ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির বাইরে রীতিমতো চেয়ার-টেবিল বসিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছে পরীক্ষার্থীরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একবার তো গ্রন্থাগারের ফটকই ভেঙে ফেলেছিল। শিক্ষার্থীরা সকাল থেকে লাইন ধরে গ্রন্থাগারে ঢোকার জন্য। সারা দিন গ্রন্থাগারে বসে বিসিএসের প্রস্তুতি নেয় তারা। এসব দৃশ্য দেখেই বোঝা যায় কতটা মরিয়া হয়ে বিসিএসের প্রস্তুতি নেয় শিক্ষার্থীরা। অন্যান্য চাকরির প্রস্তুতিও তাদের নিতে হয়। চাকরির প্রস্তুতি ও আবেদনের পেছনে বড় অঙ্কের অর্থ খরচ করে শিক্ষার্থীরা।
কিছুদিন আগে দেখলাম কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক একজনকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার পরিচতিজনেরা অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। সম্ভবত তার পদোন্নতি হয়েছে বা ভালো কোথাও পদায়ন হয়েছে। তিনি প্রশাসন ক্যাডারে আছেন। কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক একজন সরকারি চাকরি করতেই পারেন। এটা তাঁর নাগরিক অধিকার। কিন্তু কম্পিউটারবিজ্ঞান, ফার্মেসি, কেমিকৌশল, অণুজীববিজ্ঞান, প্রাণরসায়ন, প্রকৌশলবিজ্ঞানের মতো উচ্চ কারিগরি ও প্রযুক্তিবিষয়ক বিভাগে অধ্যয়ন করে নন টেকনিক্যাল ক্যাডারে চাকরি করা একটু বেমানান। যদিও সংখ্যা কম; কিন্তু কারিগরি বিষয় থেকে নন টেকনিক্যাল ক্যাডারে চলে আসা যৌক্তিক না।
জনপ্রশাসনের চাকরিতে কম্পিউটারবিজ্ঞানে স্নাতক বা ইতিহাসে স্নাতকের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য থাকে না। দুজনকেই জনপ্রশাসন নিয়ে কাজ করতে হয়। একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বাল্যবিবাহ রোধ থেকে শুরু করে জমিজমার বিরোধ পর্যন্ত—সবকিছুই দেখভাল করতে হয়। এসব মূলত রাষ্ট্রের দৈনন্দিন সাচিবিক কাজকর্ম।
অথচ রাষ্ট্রের এসব দৈনন্দিন কাজের জন্য কম্পিউটারবিজ্ঞানের একজন স্নাতককে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রস্তুত করা হয়নি। কারিগরি বিষয়গুলোর শিক্ষার্থীদের গড়ে তুলতে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাধারণ বিভাগগুলোর তুলনায় অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উদ্দেশ্য শুধু সরকারি কর্মচারী তৈরি না; দক্ষ ও মেধাবী গবেষক তৈরিই বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ, যাতে পরে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রসারে কার্যকর ভূমিকা রাখা যায়। প্রশাসন ক্যাডারে প্রবেশ করে প্রাণরসায়নে স্নাতকধারী একজন অর্জিত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কিছুই প্রয়োগ করতে পারে না।
এ অবস্থার নিরসন হওয়া খুবই জরুরি। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও সরকারি চাকরি, বিশেষ করে সিভিল সার্ভিসের নিয়োগপদ্ধতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। সিভিল সার্ভিসসহ অন্যান্য সরকারি পদে নিয়োগের জন্য একটি ইনস্টিটিউট বা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা যেতে পারে। তবে নতুন প্রতিষ্ঠান স্থাপনের দরকার নেই। বাংলাদেশ পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রেনিং সেন্টারকে জনপ্রশাসন ইনস্টিটিউটে পরিণত করে ব্যাচেলর ডিগ্রি প্রদান করা যেতে পারে।
আগ্রহী প্রার্থীরা এইচএসসির পর ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে জনপ্রশাসন বিষয়ে উচ্চপর্যায়ের শিক্ষাজীবন শুরু করবেন। প্রতিবছর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানানো হবে আসনসংখ্যা। জনপ্রশাসন খাতে আগামী কয়েক বছরের সম্ভাব্য চাহিদা অনুসারে আসনসংখ্যা নির্ধারণ করা হবে। ওই প্রতিষ্ঠানে শুধু জনপ্রশাসন বিষয়েই চার বছর মেয়াদি ব্যাচেলর ডিগ্রি প্রদান করা হবে।
প্রথম চার সেমিস্টারে জনপ্রশাসনের সাধারণ বিষয়ে সব শিক্ষার্থীকে পাঠদান করা হবে। পঞ্চম সেমিস্টার থেকে শিক্ষার্থীদের পূর্ববর্তী সেমিস্টারের ফলাফলের ভিত্তিতে বিভিন্ন ক্যাডারে ভাগ করে দেওয়া হবে। যদি কেউ পুলিশ বিভাগে চাকরি নিতে চায়, তবে পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম সেমিস্টারে পুলিশ সায়েন্স, অপরাধবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিবিড় পাঠ গ্রহণ করবে বা কেউ যদি পররাষ্ট্র ক্যাডার পছন্দ করে, তবে আন্তর্জাতিক রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন বিষয়ে পড়াশোনা করবে। শেষ সেমিস্টারে শিক্ষানবিশ হিসেবে ছয় মাস সংশ্লিষ্ট ক্যাডারের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবে।
শিক্ষানবিশকালে চাকরির মূল্যায়ন ও স্নাতক শ্রেণির ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কর্মকমিশন শিক্ষার্থীদের সরাসরি বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগ করবে। যারা কোনো ক্যাডারে সুযোগ পাবে না, চাকরির বয়সসীমা পর্যন্ত প্রতিবারই তাদের নিয়োগের জন্য বিবেচনা করা হবে। অন্যান্য চাকরিতেও তারা আবেদন করতে পারবে।
জনপ্রশাসন ইনস্টিটিউটের একাধিক ক্যাম্পাস স্থাপন করতে হবে। চার বছরে আটটি সেমিস্টারের জন্য বিভিন্ন শহরে কমপক্ষে চারটি ক্যাম্পাস করা যেতে পারে। প্রতিটি ক্যাম্পাসেই শিক্ষার্থীদের ভাগ করে দেওয়া হবে। একটি ইনস্টিটিউটে প্রথম দুই সেমিস্টার অধ্যয়নের পর শিক্ষার্থীরা পরের দুই সেমিস্টারে অন্য ক্যাম্পাসে চলে যাবে। এভাবে দুটি সেমিস্টার একটি ক্যাম্পাসে পড়াশোনার সুযোগ পাবে। এতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে দুর্নীতির সুযোগ কমে আসবে। পরীক্ষার ফলাফলে প্রকৃত মেধার যাচাই করা সহজ হবে। পক্ষপাতিত্বের সুযোগ কম থাকবে। এসব ইনস্টিটিউটে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সাবেক ও বর্তমান আমলা ও সামরিক কর্মকর্তারা পাঠদান করবেন। তবে কিছু স্থায়ী শিক্ষকও নিয়োগ করতে হবে।
এ ধরনের ইনস্টিটিউট স্থাপন করলে সরকারের কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ ব্যয় হ্রাস পাবে। চাকরিতে প্রবেশের পর নতুন করে আর কোনো প্রশিক্ষণ দিতে হবে না। নতুন পদ্ধতি শুরু করা হলে একজন শিক্ষার্থীকে চার বছরে হাতেকলমে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করা হবে। ফলে শিক্ষাজীবন শেষে শিক্ষার্থীরা দক্ষ কর্মী হিসাবেই জনপ্রশাসনে প্রবেশ করবে।
উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পর শিক্ষার্থীরাই ঠিক করবে তারা কোন পথে অগ্রসর হবে। জনপ্রশাসনে যোগ দেবে, নাকি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নিয়ে অন্যান্য চাকরিতে প্রবেশ করবে। আরেকটি জিনিস মাথায় রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে গবেষণামূলক অভিসন্দর্ভ রচনা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। অভিসন্দর্ভ তত্ত্বাবধানের জন্য যদি পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকে, তবে প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমিয়ে ভর্তি করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা একজনকে অবশ্যই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অভিসন্দর্ভ রচনা করা জানতে হবে। কিন্তু মূল লক্ষ্য থাকবে গবেষক তৈরি করা। গবেষক হওয়া সহজ না। ইউরোপ-আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিবছর গবেষক বের হয় লাখ লাখ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাড়া জাগাতে পারে অল্প কয়েকজনই। শ্রমবাজারে শিক্ষিত জনবল সরবরাহের কাজ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোই করতে পারবে। প্রয়োজনে এসব কলেজকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে হবে।
সামরিক বাহিনী, প্রকৌশলবিদ্যা ও চিকিৎসাশাস্ত্রের জন্য যদি উচ্চমাধ্যমিকের পরই পৃথক পরীক্ষার সুযোগ থাকে, তবে জনপ্রশাসনের জন্য থাকবে না কেন। বরং আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ থাকলে শিক্ষার্থীদের ওপরও চাপ কমে আসবে। বর্তমানে একজন শিক্ষার্থীকে দ্বিগুণ পড়াশোনা করতে হয়। একদিকে বিসিএসের প্রস্তুতি, আরেক দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা। তাদের একই সঙ্গে পৃথিবীর সর্বোচ্চ মালভূমির নাম মুখস্থ রাখতে হয়, ‘চর্যাপদ’-এর কবিদের নাম মনে রাখতে হয়, আবার রসায়নের জটিল সব বিক্রিয়া নিয়ে কাজ করতে হয়। শিক্ষার্থীদের এই অতিরিক্ত চাপ থেকে মুক্তি দেওয়া জরুরি। এ জন্যই বিসিএস পরীক্ষা বাতিল করা প্রয়োজন। নতুন করে, নতুনভাবে আমাদের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ও সিভিল সার্ভিসের নিয়োগ নিয়ে ভাবতে হবে। ব্রিটিশ আমলের সরকারি কর্মকর্তা নিয়োগের ধারণা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক