চাকরিজীবীরাও সব ধরনের বিনিয়োগ ও খরচের পরিকল্পনা থেকে সরে এসে সঞ্চয় শুরু করেন। বিদেশ থেকে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বাড়লেও সেই তুলনায় উত্তোলন হয়েছে কম। সব মিলিয়ে করোনাভাইরাসের মধ্যে ব্যাংকগুলোয় আমানতে বড় ধরনের উল্লম্ফন ঘটেছে।
এদিকে করোনাভাইরাসে ব্যবসায়ীরা গুটিয়ে গেলেও কম সুদের প্রণোদনা ঋণে যেন আবার প্রাণ ফিরে পান। পুরোনো ঋণ পরিশোধেই হোক বা চলতি মূলধনের জন্যই হোক, ব্যবসায়ীরা ঋণ নিচ্ছেন। ফলে গত বছর মানে ২০২০ সালে ঋণ বিতরণ ভালো হয়েছে। ব্যাংকগুলোর জুলাই-জানুয়ারি সময়ের তথ্য পর্যালোচনায় এমন চিত্র পাওয়া গেছে। এরপরও ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ ২ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। বিশাল এই তারল্যের একটি বড় অংশ বিল-বন্ডে বিনিয়োগ করেছে। বাকি টাকা ব্যাংকগুলোতে অলস পড়ে রয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, করোনার মধ্যে প্রবাসী আয় অনেক বেশি এসেছে। এসব টাকার বড় অংশ ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা হয়েছে। আগে যাঁরা সঞ্চয় করেননি, তাঁরাও করোনাকালে সঞ্চয় করতে শুরু করেছেন। আসলে করোনা সবাইকে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তায় ফেলে দেওয়ার কারণেই সঞ্চয়ের প্রবণতা ও পরিমাণ বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমানত রয়েছে সোনালীর। গত ডিসেম্বর শেষে এই ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৫ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে ৯ হাজার ৪৭৮ কোটি টাকা। সোনালীর পেছনে রয়েছে অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক।
জানতে চাইলে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান প্রধান বলেন, ‘করোনার মধ্যে আমানতে নতুন চিত্র দেখতে পেয়েছি। এক বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আমানত বেড়েছে। মানুষ খরচ কমিয়ে সঞ্চয় বাড়িয়ে দিয়েছে। আর নতুন প্রকল্প না হওয়ায় তেমন ঋণও যাচ্ছে না।’
পূবালী ব্যাংকে গচ্ছিত আমানতের পরিমাণ ৪৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা, যা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এরপরই ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে ৪৩ হাজার ১৫৮ কোটি ও ন্যাশনাল ব্যাংকে ৪২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার আমানত রয়েছে।
পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্বে) শফিউল আলম খান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনায় অনেক ব্যবসায়ী চুপ হয়ে পড়েছিলেন। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণিও ঝুঁকি নিয়ে কোথাও বিনিয়োগ করেননি, টাকা খরচ না করে সঞ্চয় করেছেন। ভবিষ্যতে কী পরিস্থিতি আসে, সেই বিবেচনা করে সবাই সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এ কারণেই আমরা ভালো আমানত পেয়েছি, যা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি।’
এদিকে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে ব্যাংকগুলো মোট ৯৫ হাজার ৭২৯ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে। ফলে সার্বিক ঋণের পরিমাণ গত জানুয়ারিতে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৪৮ হাজার ২১৯ কোটি টাকা, যা গত বছরের জুনের শেষে ছিল ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। আগের ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ বিতরণ হয়েছিল ৯৬ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। তার আগের ২০১৮-১৯ সালের একই সময়ে ঋণ বিতরণ হয়েছিল ৬৭ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা।
বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের করোনার প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তা করতে সরকার কম সুদের প্রায় এক লাখ কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করে। ওই প্যাকেজের ঋণ বিতরণ এখনো চলছে। ইতিমধ্যে ৭০ হাজার কোটি টাকার মতো বিতরণ হয়েছে। প্রণোদনা প্যাকেজের ফলে জুলাই-জানুয়ারি সময়ে ঋণ বিতরণ আগের বছরের একই সময়ের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
জানতে চাইলে চতুর্থ প্রজন্মের মিডল্যান্ড ব্যাংকের এমডি আহসান-উজ জামান বলেন, ‘এই সময়ে প্রণোদনা ঋণের পাশাপাশি অন্য ঋণেরও বিতরণ চলছে। কিছু গ্রাহক কারখানার ক্ষমতা বাড়ানোরও উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা তাঁদের ঋণ প্রদান করছি। তবে যেভাবে নতুন বিনিয়োগের প্রত্যাশা, সেভাবে হচ্ছে না।’
এই প্রজন্মের এনআরবি ব্যাংকের এমডি মামুন মাহমুদ শাহ প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ জীবনযাত্রার খরচ কমিয়ে সঞ্চয় বাড়িয়েছে। আর কম সুদের ঋণ পাওয়ায় বিতরণও বেড়েছে। প্রণোদনা ঋণই এখন অর্থনীতির চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
সানাউল্লাহ সাকিব