বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই একের পর এক বিস্ময় দেখিয়ে আসছে। ১৯৭১ সালে দেশটি (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) স্বাধীনতাযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। সেই মুক্তিযুদ্ধ নস্যাৎ করতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্বিচার ধর্ষণ ও গণহত্যা চালায় এবং বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হয়ে প্রতিবেশী ভারতে আশ্রয় নেয়। তখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পক্ষে কঠোর অবস্থান নেন। আমি তখন দিল্লিতে স্নাতকে পড়তাম। বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষজনকে সাহায্য করতে আমি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যা রাজ্যের বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে ছুটে যাই।
১৯৭১ সালের ২ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সঙ্গে সর্বাত্মক বিমানযুদ্ধ শুরু হয়। এখনো স্পষ্ট মনে করতে পারি, আমি কলেজে ফেরার জন্য কলকাতা থেকে রাতের ট্রেন ধরি। তখন কারফিউ বা সান্ধ্য আইন জারি ছিল। বিমান হামলার আশঙ্কায় ট্রেনের সব কমপার্টমেন্ট বা বগির বাতি নিভিয়ে রাখা হয়।
স্বাধীনতা লাভের সময় বাংলাদেশ ছিল এশিয়ার সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটি। ভারতের চেয়েও, এমনকি পাকিস্তানের চেয়েও অনেক দরিদ্র ছিল বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রের তখনকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার তো বাংলাদেশকে ‘বাস্কেট কেস’ বা ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ বলে মন্তব্য করেন। এরপর বেশ কয়েক বছর বাংলাদেশে ব্যাপক দারিদ্র্য ও বঞ্চনার চিত্র দেখা যায়। এমন অবস্থায় ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে যখন দুর্ভিক্ষ চলছিল, তখন হঠাৎ করে তাদের জন্য খাদ্যসহায়তা পাঠানো বন্ধ করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন সরকার। ওই সময়ে পাটের ব্যাগ রপ্তানি করে বাংলাদেশের অল্প কিছু আয় হতো। ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়।
বাংলাদেশ এখন স্বাধীনতার ৫০ বা সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব করছে। দেশটি অর্থনৈতিক উন্নয়নে দারুণ এক জায়গায় চলে গেছে। একসময় কেবল অল্প কিছু মানুষই বাংলাদেশের এমন উন্নতির পূর্বাভাস দিতেন। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ যখন মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের হারে পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে যায়, তখন অনেকেই সেটাকে আকস্মিক সৌভাগ্য বলে উড়িয়ে দেন। কিন্তু সেই থেকে প্রতিবছরই জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ এগোতে থাকে। তার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এখন বিস্ময়করভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান অর্থনীতিগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।
বাংলাদেশ মাথাপিছু জিডিপির হারে পাকিস্তানকে বেশ পেছনে ফেলে দিয়েছে এবং ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৭৪ বছর, যা প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। ভারত ও পাকিস্তানে মানুষের গড় আয়ু যথাক্রমে ৭০ ও ৬৮ বছর। বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশ এখন নেতৃত্বের আসনে রয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও এগিয়ে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের সমৃদ্ধিশালী হয়ে ওঠার কথা বলা যায়। এ দেশে ৩০০টি ওষুধ কোম্পানি রয়েছে, যারা স্থানীয় চাহিদার ৯৭ শতাংশ মিটিয়ে থাকে। এমনকি তারা বৈশ্বিক বাজারেও ওষুধ রপ্তানি করছে।
তবে এ কথাও সত্য যে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার যথেষ্ট, অসচ্ছলতা বিদ্যমান, বৈষম্য বাড়ছে এবং ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা আবারও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বিঘ্ন ঘটাতে পারে। তা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক রূপান্তরে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। বদৌলতে বিশ্বব্যাংক এখন বাংলাদেশকে নিম্ন–মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা দিতে চলেছে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক সফলতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশ প্রভূত প্রশংসা পাওয়ার দাবি রাখে। দেশটি তাদের কাছ থেকে বর্তমান বিশ্বের স্বল্প আয়ের দেশগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা নেওয়ার পথ দেখিয়ে রেখেছে।
বাংলাদেশের উত্থান মানে একই সঙ্গে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও সুযোগ যথাযথভাবে কাজে লাগানোর এক গল্প। দেশটির সফলতা অর্জনে প্রগতিশীল বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) বড় অবদান রয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় নাম হলো ব্র্যাকের ফজলে হাসান আবেদ এবং গ্রামীণ ব্যাংকের মুহাম্মদ ইউনূস। প্রাথমিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি চালু করে পরিবারের জ্যেষ্ঠ নারী সদস্যদের ঋণ দিতে শুরু করায় তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমি সব সময় সব জায়গায় বলে আসছি, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে আয়-উপার্জনের ফলে পরিবারে নারীদের অবস্থান পোক্ত হয়েছে এবং এতে শিশুদের মঙ্গলের জন্য পরিবারের ব্যয় বেড়েছে। আর এটিই হলো বাংলাদেশে গড় আয়ু ও শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং পুষ্টিহীনতা রোধের বড় কারণগুলোর একটি।
বিশ্বের যেসব দেশে সবচেয়ে বৃহৎ পরিসরে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমই পারিবারিক পর্যায়ে বাংলাদেশের মানুষকে ঋণের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা এবং নিজস্ব ক্ষুদ্র ব্যবসা পরিচালনার পথ দেখিয়েছে। সেলিম রায়হান, এস আর ওসমানী, এম এ বাকি খলিলী সাধারণ ভারসাম্য মডেল ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে পারিবারিক পর্যায়ে অর্থসহায়তার চেয়ে ক্ষুদ্রঋণ প্রদান করলেই তার ফল বেশি ভালো হয়। এ ছাড়া সহায়তামূলক আর্থিক ও মুদ্রানীতি নেওয়ার ফলে জিডিপি ৯ থেকে ১২ শতাংশ বেড়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের সফলতা অর্জনের পেছনে ভাগ্যের ব্যাপারও আছে। ভারত উপমহাদেশের শ্রম আইনগুলো বেশ জটিল, বিশেষ করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিসপুটস অ্যাক্ট বা শিল্প বিরোধ আইন। এসব আইন ভারত ও পাকিস্তানের ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ারও আগেকার। এগুলো বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে বাধা হয়ে আছে। পাকিস্তান ১৯৫৮ সালে এই আইন বাতিল করলেও তা ছিল ভুল কারণে। যেমন তারা বড় বড় সংস্থাকে শ্রমিক নিয়ন্ত্রণের সুযোগ করে দেয়।
বাংলাদেশ একসময় পাকিস্তানের অংশ ছিল। জন্ম তথা স্বাধীনতা লাভের সময় কোনো আইন ছিল না। তবে বাংলাদেশ তার শ্রম আইনে পাকিস্তানের মতো করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে অবারিত ক্ষমতা দেয়নি, বরং তা অনেক শিথিল করায় সুফল পেয়েছে। বদৌলতে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে অন্যতম সফল উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
পরিশেষে বলব, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সফলতা অর্জনের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বড় ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রায়শ সমালোচিত হলেও দেশকে কিন্তু উন্নয়ন-সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছেন। বাংলাদেশের সংবিধান ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। তবু মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর কারণে দেশটি এই বিষয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সহজাত ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুনাম রয়েছে। তিনি অবশ্য ধ্বংসাত্মক গোষ্ঠীগুলোকে দমিয়ে রেখেছেন।
বিশ্বের অনেক দেশই ধর্মীয় মৌলবাদীদের কারণে হোঁচট খেয়েছে, যা সেই সব দেশের অর্থনীতিতে ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছে। একই ধরনের বিপদ অবশ্য বাংলাদেশকেও মোকাবিলা করতে হয়েছে। তবে এর মধ্যেও বাংলাদেশ অর্থনীতিকে চাঙা ও গতিশীল করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। স্বাধীনতার ৫০তম তথা সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে এসে তাই দেশটির অমন সাফল্যের প্রশংসা করতেই হয়।